পরীক্ষার ডামাডোলে গভর্নিং বডি নির্বাচন: শিক্ষক-অভিভাবক মহলে তীব্র উদ্বেগ
৩০ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার নির্দেশ: শিক্ষাপঞ্জির সংবেদনশীল সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে শিক্ষাব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক: শিক্ষাবর্ষের সবচেয়ে সংবেদনশীল সময়—নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া নির্দেশিকা শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ, প্রথাগতভাবে এই নির্বাচন বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হলেও এবার তা এগিয়ে আনা হয়েছে বার্ষিক ও নির্বাচনী পরীক্ষার ঠিক মাঝখানে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা শিক্ষাব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিবেশকে ব্যাহত করতে পারে।
সংবেদনশীল সময়ে নির্বাচনের নির্দেশ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন শেষ করতে হবে। অথচ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী, এই সময়টিই শিক্ষার্থীদের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতির এবং পরীক্ষার সময়।
ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা: ২০ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা: ২৯ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
শিক্ষার্থীরা যখন পড়াশোনা নিয়ে চূড়ান্তভাবে ব্যস্ত, শিক্ষকেরা প্রশ্নপত্র তৈরি ও পরীক্ষা পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, ঠিক তখনই নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্তে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকেরা শঙ্কিত। তাঁদের মতে, এই সময়ে নির্বাচন আয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থার স্বাভাবিক রুটিন ও পরিবেশ নিশ্চিতভাবেই বিঘ্নিত হবে।
প্রথা ভাঙার কারণ ও উদ্বেগের জায়গা
প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী, শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ফেব্রুয়ারি মাসে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময়ে পাঠদানের চাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকায় নির্বাচন ঘিরে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সবার অংশগ্রহণও স্বতঃস্ফূর্ত থাকে। কিন্তু এবার পরীক্ষার সময় নির্বাচন হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে পরীক্ষার পাশাপাশি ভোটের প্রস্তুতি, বুথ স্থাপন এবং নির্বাচন আয়োজনের অতিরিক্ত চাপ নিতে হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একাধিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষক বলেন, "একই সময়ে নির্বাচন ও পরীক্ষা নিশ্চিতভাবেই পরীক্ষার্থীদের জন্য অসুবিধা তৈরি করবে। কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি স্পষ্ট নয়। মন্ত্রণালয়ের উচিত অবশ্যই দুটি বিষয়ের রুটিনের মধ্যে সমন্বয় করা।"
অন্যদিকে অভিভাবকেরা সন্তানের পরীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকার সময় নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়লে তা সন্তানের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। নির্বাচনের কারণে স্কুলের স্বাভাবিক রুটিন ও পরিবেশ বিঘ্নিত হলে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
আগাম প্রচারণায় সরগরম ক্যাম্পাস
নির্বাচনের এখনো দেড় মাস বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে বিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ের পরিচালনা নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে। গেল সপ্তাহে ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আসন্ন গভর্নিং বডি নির্বাচন - ২০২৫ আয়োজন উপলক্ষে বনশ্রী শাখা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরামের একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় কলেজ শাখার প্রার্থী হিসেবে আহসান উল্ল্যা মানিককে মনোনীত করে অভিভাবকদের প্রতি তাঁকে নির্বাচিত করার আহবান জানানো হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু। তিনি আগাম প্রচারণার বিষয়ে বলেন, "কলেজের নির্বাচন নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের ব্যস্ততা বাড়ে। ঢাকার বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন প্রচার শুরু হয়ে গেছে, এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই।" তবে তিনি জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন এগিয়ে আনা বা পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। একই সঙ্গে শিক্ষক প্রতিনিধিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, "শিক্ষক প্রতিনিধি মানে হচ্ছে একটি দল বা উপদল তৈরি করা। এই বিষয়টি নির্বাচনে বাদ দেওয়া উচিত।"
মন্ত্রণালয়ের নীরবতা
সাধারণ অভিভাবক এবং শিক্ষক মহলের প্রশ্ন হলো—শিক্ষাবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পার হওয়ার মুহূর্তে এমন স্পর্শকাতর সময়ে নির্বাচন আয়োজনের তাড়াহুড়ো কেন? যদিও দীর্ঘদিন ধরে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটির নির্বাচন হয়নি, সেই দিকে মন্ত্রণালয়ের নজর কম থাকলেও পরীক্ষার সময় এই সিদ্ধান্ত কার্যকরের যৌক্তিকতা কী? শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে কিনা, তা নিয়ে এখন শিক্ষামহলে জোর আলোচনা চলছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরারকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, "এ বিষয়ে আসলে আমার বলার কিছু নেই। এটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক এটি নিয়ে কাজ করছেন, তিনি ভালো বলতে পারবেন।" তবে বিদ্যালয় পরিদর্শক ও শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।