স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি ১ হাজার ৮৯টি মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্তির চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে শেষ মুহূর্তে নীতিমালার জটিলতায় এর মধ্যে ৬০৯টি মাদ্রাসা বাদ পড়তে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের নির্দেশে নতুন (২০২৫) নীতিমালার পরিবর্তে পুরোনো (২০১৮) এমপিও নীতিমালা অনুসরণ করতে হওয়ায় এই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর এমপিওভুক্তির স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে এসে অনেক প্রতিষ্ঠানই তালিকায় ঠাঁই পাচ্ছে না। হতাশা আর নিরাশায় ভর করেছে বাদ পড়া মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের মন।
জমি-সংক্রান্ত শর্তেই বাদ পড়ছে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান
৩ নভেম্বর সরকার শর্তসাপেক্ষে ১ হাজার ৮৯টি মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্তির অনুমোদন দেয়। কিন্তু ২০১৮ সালের নীতিমালায় ইবতেদায়ি মাদ্রাসার জন্য জমির পরিমাণ নির্ধারিত—মহানগরে ১০ শতক, পৌর এলাকায় ২০ শতক ও মফস্বলে ৩৩ শতক। অন্যদিকে ২০২৫ সালের নতুন নীতিমালায় এই শর্ত শিথিল করে যথাক্রমে ৮, ১২ ও ২৫ শতক করা হয়েছিল।
পুরোনো নীতিমালা প্রয়োগ করায় জমির শর্ত পূরণ না করতে পারায় বাদ পড়ছে ৬০৯টি মাদ্রাসা। ফলে এমপিওভুক্তির তালিকায় থাকছে মাত্র ৪৮০টি।
নীতিমালা বদলের কারণ—ব্যয় সংকোচন
সরকারি হিসাব বলছে, সব ১ হাজার ৮৯টি মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করতে গেলে বছরে অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ১৪২ কোটি টাকা। প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় মনে করেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ব্যয় বহন সম্ভব নয়। তাই ব্যয় কমাতে পুরোনো নীতিমালা কার্যকর করা হয়েছে, যাতে তালিকা নেমে আসে ৪৮০-তে। এতে সরকারের প্রায় ৯০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
এমপিওভুক্ত একটি মাদ্রাসায় ছয়টি পদ থাকে—প্রধান শিক্ষক, তিনজন সহকারী শিক্ষক, একজন কারি/নূরানি শিক্ষক এবং একজন অফিস সহায়ক। এ হিসেবে পূর্ণ তালিকায় এমপিওভুক্ত হলে নতুন নিয়োগ হতো ৬ হাজার ৫৩৪ জন জনবল। তাদের বেতন-ভাতাই বড় অঙ্কের বাড়তি ব্যয় তৈরি করত।
মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই মতবিরোধ
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. রফিকুল ইসলাম জানান, “প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টা দপ্তর থেকেই অনুমোদিত হয়েছে। আমরা কেবল নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি।”
তবে মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তাদের মত, নতুন নীতিমালা জারি হওয়ার পর পুরোনো নীতিমালা প্রয়োগের নজির নেই। এতে আইনি জটিলতার আশঙ্কাও রয়েছে—কেউ চাইলে আদালতে যেতে পারে, আর এতে পুরো প্রক্রিয়া আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শিক্ষকদের হতাশা ও আশঙ্কা
বর্তমানে ১ হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সামান্য সরকারি অনুদান পায়—প্রধান শিক্ষকের জন্য মাসে ৫ হাজার টাকা, সহকারী শিক্ষকের জন্য ৩ হাজার টাকা। আরও ৫ হাজার ৯৩২টি মাদ্রাসা কোনো ধরনের সরকারি সহায়তাই পায় না।
এ অবস্থায় নীলফামারীর জলঢাকা থেকে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষক মশিউর রহমান বলেন,
“প্রথমবার এমপিওভুক্তির ঘোষণা এলে আমাদের আশা বেড়েছিল। কিন্তু কঠোর শর্ত নতুন করে ফাঁদে ফেলল। সরকার বদল হলে আবার টালবাহানা শুরু হবে—শেষ পর্যন্ত হয়তো এমপিও হবেই না।”
স্বতন্ত্র ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান কাজী মুখলেছুর রহমান জানান,
“সরকার আমাদের দাবি মেনে এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এজন্য কৃতজ্ঞ। তবে নতুন নীতিমালায় হলে আরও ভালো হতো। যেহেতু পুরোনো নীতিমালা অনুসরণ হবে, আমরা তা মেনে নিচ্ছি—শর্ত হলো, বাদ পড়া মাদ্রাসাগুলোকে যেন পর্যায়ক্রমে এমপিওভুক্ত করা হয়।”
দীর্ঘ আন্দোলনের পর শেষ মুহূর্তে নতুন জট
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা দুই যুগ ধরে এমপিও ও জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। গত কয়েক বছরে আন্দোলন নতুন করে ঘনীভূত হয়, বিশেষত গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারির শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর সরকার নতুন নীতিমালা জারি করে।
তবুও বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত ১৩ অক্টোবর থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে ২২ দিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকে। এর মধ্যেই আসে ৩ নভেম্বরের অনুমোদনের ঘোষণা—যা আবার জমির শর্তে আটকে গেল।